নানা রঙের দিন
একাঙ্ক নাটক কাকে বলে ?' নানা রঙের দিন ’ একাঙ্ক নাটক হিসাবে সার্থক কি না বুঝিয়ে দাও ।
==> * এক অঙ্কবিশিষ্ট নাটককেই বলা হয় একাঙ্ক নাটক । এই জাতীয় নাটকে একাধিক দৃশ্যের সমন্বয় থাকে । চরিত্র সংখ্যাও স্বল্প হয় । একাঙ্ক নাটক আধুনিক কালের সৃষ্টি ।
** গ্রিক দেশে যখন প্রথম নাটক লেখা শুরু হয় তখন সেখানে কোনো অঙ্ক বা Act ছিল না । রোমানরা প্রথম অঙ্ক বা Act বিশিষ্ট নাটক লেখা শুরু করে । তাদের নাটক গুলিতে সাধারণত ৫টি অঙ্ক থাকত । আধুনিক সময়ে এই একাঙ্ক নাটকের সৃষ্টি হয় । সাধারণভাবে এক অঙ্কবিশিষ্ট নাটককে একাঙ্ক নাটক বলে চিহ্নিত করা হয় ।এই ধরনের নাটকের কতগুলি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে । কয়েকটি দৃশ্য সহযােগে একাঙ্ক গড়ে উঠতে পারে , আবার কোনাে দৃশ্যবিভাগ না - ও থাকতে পারে । নাটকটিতে চরিত্র সংখ্যা বেশি দেখা যায় না । এই নাটকের কাহিনি খুব দ্রুতগতিতে পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় । একটিমাত্র ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নাট্যদ্বন্দ্ব ঘনীভূত হয় । কোনাে উপ - কাহিনি থাকে না । এই সব বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে আমরা বিচার করতে পারি 'নানা রঙের দিন ’ নাটক একাঙ্ক নাটক কি না ?
কম সময়ের নাটক:-
‘ নানা রঙের দিন ’ নাটকটির সমগ্র ঘটনাটি একটি রাতের কয়েকটি ঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ ।
কম চরিত্র সংখ্যা:-
নানা রঙের দিন নাটকে মাত্র দুটি চরিত্র রয়েছে । এই নাটকের দুটি চরিত্র হল আটষট্টি বছরের বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় ও ৬২ বছরের বৃদ্ধ প্রম্পটার কালীনাথ সেন ।
একটিমাত্র ঘটনা:-
সমগ্র নাটকটি একদা নাট্য রঙ্গমঞ্চের বিখ্যাত অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের অতীত ও বর্তমানের দ্বান্দ্বিক পটভূমিতে রচিত । অতীত গৌরবকে পাথেয় করে রজনীকান্ত নাট্যমঞ্চে প্রাসঙ্গিক হয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে অবস্থান করতে চাইলেও বয়স ও শরীর তাকে পিছু টেনেছে ।
দ্রুত গতি :-
নাটকের ঘটনা শুরু থেকে দ্রুত পরিণতির পথে এগিয়েছে । মধ্যরাতের শূন্য প্রেক্ষাগৃহে প্রচুর মদ্যপান করে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের দীর্ঘ সংলাপ দিয়ে নাটকের সূচনা হয়েছে । তার বিভিন্ন সংলাপের মধ্য দিয়ে অতিদ্রুত নাট্য কাহিনী পরিণতির দিকে এগিয়ে গিয়েছে।
সংলাপে দ্রুততা :-
পূর্ণাঙ্গ নাটকে একাধিক চরিত্র , একাধিক শাখা কাহিনি ( Sub plot ) , দীর্ঘ সংলাপ থাকতে পারে । একাঙ্ক নাটকে সংলাপের দ্রুততা অবশ্যই কাম্য । নানা রঙের দিন ’ নাটকে দীর্ঘ সংলাপের পাশে দেখা যায় ছােটো ছােটো সংলাপ এসেছে এবং সেই সংলাপগুলি নাট্যকাহিনির দ্বন্দ্ব ( conflict ) - কে অতিদ্রুত পরিণতি দান করেছে ।যেমন-
“ পিতা ! সম্রাট সাজাহান কি বন্দী ? ” রজনী : “ না ! কে বলেছে ? ” কালীনাথ : “ তবে তাকে প্রাসাদে রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে । কেন ? ” রজনী : “ সেরূপ প্রয়ােজন হয়েছে । ”
এইভাবে সমগ্র নাটকটি দ্রুতগতিতে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের জীবনকে কেন্দ্র করে মানব জীবনের দ্যোতনাকে ফুটিয়ে তুলেছে । তাই এটি সার্থক একাঙ্ক নাটক ।
২) নানা রঙের দিন নাটকের নামকরণের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো ।
‘ দিনগুলি মাের সােনার খাঁচায় রইল না
সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি ' ।
মঞ্চের অভিজ্ঞতাই হল একজন নাট্যকর্মী যা নাট্যশিল্পীর মূল পুঁজি । এই সম্পদই তাকে অভিনয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবনা ও প্রেরণার দিকে আকর্ষণ করে , শিল্পবােধে উত্তীর্ণ করে । প্রতিটি শিল্পের আনন্দময় অভিজ্ঞতাকে সম্বল করেই শিল্পী পথ চলেন, অভিজ্ঞতার বিস্তৃতি ঘটান, এভাবে তাঁরও আত্ম উন্নতি ঘটে ।
একজন নাট্যকর্মীও নিজের প্রতিভার উন্মােচন ঘটান মঞ্চের উজ্জ্বল আলােয়, অভিনয়ের মাধ্যমে, বিভিন্ন চরিত্রের রূপায়ণে, কণ্ঠস্বরের ওঠা - নামার শিল্পিক প্রয়ােগে । রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়, সদ্বংশের পবিত্র রক্ত যাঁর গায়ে, তিনি পুলিশ ইন্সপেক্টরের লােভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে অভিনয়কেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন । তিনি জানতেন যে, এ পেশার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত । তবু মঞ্চকেই তিনি বেছে নিয়েছেন । পঁয়তাল্লিশ বছর মঞ্চকেই তিনি আঁকড়ে রয়েছেন । সংসার - পরিজন নেই তার । তিনি একা, নিঃসঙ্গ । মঞ্চই তার ধ্যান - জ্ঞান - স্বজন ।
এই মঞ্চেই তিনি দিলদারের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন । সাজাহানের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন । ঔরঙ্গজেবের ভূমিকাতেও অভিনয় করেছেন । অসংখ্য লােকের অজস্রবার গর্বিত ছিলেন । বয়েস বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গলার কাজ নষ্ট হয় । প্রৌঢ় জীবনে এসে যৌবনের রঙিন দিনগুলির কথা ভাবতে থাকেন রজনীকান্ত । তিনি উপলব্ধি করেন, পাবলিকের কাছে যতই হাততালি - প্রশংসা লাভ করুন না কেন, তিনি তাদের কাছে
' থিয়েটারওয়ালা, একটা নকলনবীশ, একটা অস্পৃশ্য ভাড়, একটা বেশ্যা ’ -
এর বেশি প্রাপ্তি নেই তার । দর্শক শ্রোতাকে বহুকাল ধরে মনােরঞ্জন করার চরম প্রাপ্তি হল শূন্যতা । সামাজিক সম্মান বা স্বীকৃতি তার জন্য নয় । জীবনের পাত্রও শূন্যতায় পূর্ণ । জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে অতীতের বর্ণময় রঙিন দিনগুলি মনে পড়ে তার, বিষাদ ও হাহাকারই তার নিয়তি হয়ে ওঠে এই একাঙ্ক নাটকে । এদিক থেকে' নানা রঙের দিন ’ নামকরণটি সঙ্গত বলে মনে হয় ।
৩) “ যারা বলে ‘ নাট্যাভিনয় একটি পবিত্র শিল্প ’ - তারা সব গাধা - গাধা ” --- বক্তার এইরূপ উক্তির / মনােভাবের কারণ কী ?
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ' নানা রঙের দিন ’ নাটকের প্রধান চরিত্র পেশাদারী থিয়েটারের প্রাক্তন অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় । থিয়েটারের সাধারণ দর্শক অর্থাৎ টিকিট কেনা খদ্দেরদের প্রতি তাঁর মনােভাব বিরূপ ।
তারা থিয়েটারের লােকের সঙ্গে আলাপ - পরিচয় করে, চা - টা খাওয়ায় , কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনােরকম সামাজিক সম্পর্ক স্বীকার করে না থিয়েটারের অভিনেতার সঙ্গে কেউ নিজের বােন বা মেয়ের বিয়েও দেবে না বলে রজনীবাবু মনে করেন । যতক্ষণ অভিনেতারা স্টেজে থাকেন ততক্ষণ কদর । তারপর যে যার ঘরে ফিরে যায়, তাদের কথা কেউ মনেও রাখে না । রজনীবাবুর মতে, এই সমস্ত দর্শকদের চোখে ‘ অভিনেতা মানে একটা চাকর একটা জোকার , একটা ক্লাউন ' ।
দর্শকদের হাততালি , প্রশংসাও সারশূন্য । রজনীবাবু ধিক্কারের সঙ্গে জানান “ যারা বলে ‘ নাট্যাভিনয় একটি পবিত্র শিল্প ’ –তারা সব গাধা - গাধা ” । আসলে রজনীবাবুর এই মনােভাবের পিছনে একটি কারণ রয়েছে । যখন তাঁর বয়স কম ছিল, একটি মেয়ে এসেছিল তাঁর জীবনে । তাঁর অভিনয় দেখে মেয়েটি নিজে থেকেই । এসে আলাপ করেছিল । আলাপ থেকেই ঘনিষ্ঠতা এবং তারপর নাটকীয় ধারাতেই প্রেম । মেয়েটির সম্পর্কে রজনীবাবু যথেষ্ট আশাবাদী ছিলেন । তিনি নিজের মতাে করে অনেক স্বপ্ন সাজিয়ে ছিলেন তাঁদের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে ।
তারপর একদিন যখন বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলাে , মেয়েটি তাঁর সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিল । মেয়েটি রজনীবাবুকে বিয়ে করতে রাজি ছিল ; কিন্তু তাঁর শর্ত ছিল । “ তার আগে তুমি ওই থিয়েটার করা ছেড়ে দাও ” । থিয়েটারের লােকের সঙ্গে মেয়েটি প্রেম করতে পেরেছিল ; কিন্তু তাঁকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারেনি । এই করুণ জীবন - অভিজ্ঞতা রজনীবাবুর জীবন - দর্শন পুরােপুরি বদলে দিয়েছিল । এই কারণেই থিয়েটারের টিকিট - কেনা খদ্দের বা দর্শক বা পাবলিক সম্পর্কে অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের এইরূপ মনােভাব ।
৪) নানা রঙের দিন নাটক অবলম্বনে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্র বিশ্লেষণ করাে ।
নাট্যকার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি 'নানা রঙের দিন ’ নাটক । নাটকের মুখ্য চরিত্র আটষট্টি বছরের রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় । তাকে ঘিরেই নাট্য কাহিনির আবর্তন । তার স্মৃতি চারণার মধ্যে দিয়ে নাটক তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছেছে । আর সেই সুত্রে ধরা পড়েছে তার চরিত্রের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য—
১.নাট্যপ্রেমী মানুষ:-
প্রথম জীবনে রজনীকান্ত পুলিশের ইনস্পেক্টর এর চাকরি পেয়েছিলেন । কিন্তু নাটকের প্রতি অদম্য ভালােবাসা আর অকৃত্রিম টান তাকে সেই কর্মে থিতু হতে দেয়নি । তিনি অবলীলায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছে । শুধু তাই নয় শুধুমাত্র নাটকের প্রতি ভালােবাসার কারণেই তিনি ব্যক্তিজীবনে ভালােবাসার মানুষত্যাগ করতে দ্বিধা করেননি । সংসার, প্রেম, নারী— সব কিছুকেই ত্যাগ করেছেন তিনি । থিয়েটারকে ভালােবাসার কারণে ।
২ . নিঃসঙ্গ মানুষ:-
জীবনের দীর্ঘ সময় রজনীকান্তবাবু লােকের মনােরঞ্জন করেছেন । নাটকের জন্যে সংসার, ভালােবাসা ত্যাগ করেছেন । আজ তার সম্বল একাকিত্ব । অথচ বয়সের ছাপ তার একাকিত্বকে আরও বেশি বড়াে করে তুলেছে । বস্তুত নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব, তার জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
৩. নৈরাশ্যে নিমজ্জিত মানুষ :
জীবনের অনেকটা পথ চলার পর অভিনেতা রজনীকান্ত বাস্তবের মুখােমুখি দাঁড়িয়েছেন । জীবনের চূড়ান্ত সাফল্যের দিনগুলি আজ অতীত । বয়সের চাপে প্রতিভাও কিছুটা যেন হারিয়ে যেতেবসেছে । একরাশ হতাশা তাঁকে গ্রাস করে ফেলেছে ।
৪. দ্বন্দ্ব - বিক্ষুব্ধ মানুষ :-
অভিনেতা হিসেবে রজনীকান্তবাবু চুড়ান্ত সফল।কিন্তু জীবনের শেষবেলায় প্রতিভা আর নৈরাশ্যের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন । শিল্পীর দ্বান্দ্বিক টানাপােড়েন তার মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে । তাঁর মনে হয়েছে অভিনেতা একজন ভাড় ; তার কোনাে সামাজিক সম্মান নেই । যদিও শেষপর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে এসেছেন প্রতিভার মৃত্যু নেই ।
৫.অসহায় মানুষ :-
নাট্য অন্তপ্রাণ রজনীকান্ত সাবধানী জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত নন । নাটকের কারণে তিনি সুখের জীবন ত্যাগ করেছেন । তিনি সবসময় নিঃসঙ্গতায় ভুগেছেন । সমস্ত নাটক জুড়ে নিঃসঙ্গতার হাহাকার ও আত্মিক যন্ত্রণার নিরন্তর আঘাত তাকে পীড়িত করেছে ।
এভাবেই নিজস্ব চারিত্রিক দ্যুতিতে রজনীকান্তবাবু পাঠক দর্শকের মনে স্থান করে নিয়েছেন ।